অনন্যা হক: মাগুরা একটা মফস্বল শহর। এক সময় ছোট নিরিবিলি, পরিচ্ছন্ন একটা শহর ছিল,যখন আমি বেড়ে উঠেছি সেই শহরে।
শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সবাই যেন সবাই কে চিনতাম আমরা। সে সব এক অন্য রকম সমৃদ্ধ স্মৃতি বিজড়িত দিন,যা যতই ব্যস্ত থাকি না কেন,কিছু পরে পরেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে যায়।
এই শহরে আছে অগণিত চায়ের দোকান,শহরের প্রধান চত্বর থেকে শুরু করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, অলিতে গলিতে। তেমনই এক চায়ের দোকান,সবাই বলে রত্নর চায়ের দোকান, আমরা বলি রত্ন কাকার চায়ের দোকান। এটা ঐ শহরে, বিশেষ করে আমাদের এলাকায় খুব নামকরা চায়ের দোকান।
আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছু টা হেঁটে রাস্তায় উঠতেই এই দোকান টা চোখে পড়ে।অনেক গুলো বছর ধরে এই দোকান টা দেখে আসছি।দেখেছি এখানে আবাল বৃদ্ধ, বনিতা নির্বিশেষে, বিভিন্ন বয়সের মানুষের চা খাওয়ার সাথে আড্ডা দিতে। দেখেছি নিজের বাবা , চাচা দের, দেখেছি অগণিত চেনা, অচেনা যুবক দের এখানে আড্ডা দিতে, হাতে করে রত্ন কাকার বানানো এক কাপ চা।
এসব মফস্বল শহরের অনেক বড় আকর্ষণ এই চায়ের দোকান গুলো। এই চায়ের দোকানে চলে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার ঝড়। চলে মানুষের জীবনের সাথে জড়িত অবিচ্ছেদ্য বিষয় গুলো নিয়ে কথোপকথন।কারো জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, শহরের পরিচিত কারো জীবনে ঘটে যাওয়া যে কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা, কি হয় না এখানে!
রাজনৈতিক তর্ক বিতর্ক, মতবিরোধ, মতানৈক্য, সব কিছু মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত আড্ডাখানায় পরিণত হয় এই চায়ের দোকান।
এই চা বিক্রেতা হয়ে যায় চা বিক্রির সাথে সাথে অগণিত ঘটনার নীরব দর্শক, কখনও কখনও তারও হয়তো কোন মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ হয়।আর চা এর দোকান হয়ে থাকে এক যুগ থেকে যুগান্তরের কালের সাক্ষী। যেন নীরবে তার বুকে ধারণ করে যাচ্ছে, মানুষের জীবনের আড্ডা, হাসি, কথোপকথনের অজস্র কথামালা।যেসব কথায় থাকে আনন্দ, বেদনা,রাগ, ক্ষোভ,বিদ্বেষ, কখনও ঘৃনা,যেগুলো মানুষের নিজের ভেতরে একা ধারণ করতে ইচ্ছে করে না, তাই যেন পরিচিত মহলে ব্যক্ত করার এক আকুলতা থেকে মানুষ আসে মানুষের কাছে। এক কাপ চা কখনও বা হয়ে যায় এক নিমিত্ত মাত্র।আসলে মানুষ আসে প্রাণের তাড়নায়, মনের খোরাক মেটাতে।
এখানে এসে নির্জীব মানুষ সজীব হয়ে ফিরে যায়।এসব শহরের পুরুষ দের এই চায়ের দোকানের জন্য কখনও বোর হয়ে ঘরে বসে থাকতে হয় না।তাই তো তাদের জীবনে, অন্য সব কিছুর মত চায়ের দোকানের অবদান কোন অংশে কম নয়। রত্ন কাকার চায়ের দোকান–মাগুরা শহরে এক নামকরা চায়ের দোকান। অনেকের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে শহরের প্রাণ কেন্দ্রে। এ যেন এক অমলিন স্মৃতির আবাসস্থল। কখনও কোন ক্লান্ত পথিক এখানে বসে নিরিবিলি এক কাপ চা খেতে,আবার কখনও অনেক মানুষের আড্ডা কোলাহলে সরগরম হয়ে ওঠে। কত মানুষ আসে যায়, চা এর দোকান ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।কখনও বুকে নিয়ে থাকে হারিয়ে যাওয়া মানুষের কথা হাসির স্মৃতি মালা। যুগ যুগ ধরে এখানে শক্ত কাঠামো তে দাঁড়িয়ে থাক এই চায়ের দোকান, সাথে থাক আমাদের স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী,পরিচিত, অপরিচিত মানুষের প্রাণবন্ত আড্ডা আর কথোপকথনের আসর, এই কামনা করি।
মানুষের সাথে এমনই অনেক জড় বস্তুর স্মৃতি মনের মনিকোঠায় অমলিন হয়ে থাকে, মুছে ফেলা যায় না। তাই জড় হয়েও মনের আঙিনায় ফিরে ফিরে আসে।